১ড. মো. আমজাদ হোসেন, ২ড. সমজিৎ কুমার পাল
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কৃষির অবদানই সবচেয়ে বেশী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এদের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবেনা, স্বাধীনতার সুফল আসবেনা। তাই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া। বিশেষ করে শিল্পভিত্তিক কৃষি। পাকিস্তানী শাসন আমলে এদেশে বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলে শিল্পের কোন প্রসার ছিল না। একমাত্র চিনি শিল্পই এখানকার সম্পদ, যার বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বৃটিশ আমলে। তাই দেশ গড়ার দিকে নজর দিয়ে তিনি চিনি শিল্পকে নতুন করে সাজানোর জন্য জোর দিয়েছিলেন। তিনি সুসমন্বিত কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ সিস্টেম প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহের আধুনিকায়ন ও সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজন অনুভব করেন। বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। এই আদেশ বলে কৃষি গবেষণা এবং কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়।
স্বাধীনতার পূর্বকালে আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত হয় অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশাবলী। সর্বমোট ৩৫টি নির্দেশের মধ্যে ১৭ নং নির্দেশনাটি ছিল কৃষিপণ্য চলাচল এবং ক্রয়-বিক্রয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকার বিষয়ে।
ঐ নির্দেশের ২৫ নং নির্দেশের (৩) অনুচ্ছেদে আন্দোলনের উত্তাল দিনেও ব্যাংকগুলোকে যে সব বিষয়ে অর্থ দান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল “চিনি কলের জন্য আখ এবং পাটকলের জন্য পাটসহ শিল্পের কাঁচামাল কেনার জন্য অর্থ দান।”
অর্থাৎ সেই উত্তাল দিনেও তিনি আবেগে হারিয়ে না গিয়ে কৃষি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। যার মধ্যে আখ ছিল অন্যতম। এভাবেই আখের প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রস্ফুটন ঘটে, যা চ‚ড়ান্ত রূপ পায় স্বাধীনতার পর।
এসব বিবেচনা করেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জাতির পিতা ১৯৭২ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর আদেশ বলে বাংলাদেশ সুগার মিলস্ করপোরেশন গঠন করেন। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।
যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ইক্ষু চারা পরীক্ষাগার নামে এদেশে ১৯৩১ সালে ঢাকার মনিপুরি পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঈশ্বরদীতে ১৯৫১ সালে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইক্ষু গবেষণা স্টেশন) রূপলাভ করে তা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে পুনর্গঠিত করে ১৯৭৩ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেন। কারণ তিনি জানতেন গবেষণা ছাড়া কোন ফসলের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বিদেশ থেকে জাত কিংবা প্রযুক্তি এনে দেশের কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই গবেষণার পাশাপাশি ইক্ষু চাষ বাড়ানোর এবং চিনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি ‘নিবিড় ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প’ ও ‘খামার আধুনিকীকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নতুন চিনিকল স্থাপন ও বিদ্যমান কয়েকটি চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন। চিনির পাশাপাশি গুড় শিল্পের উন্নয়নেও তার ছিল যথেষ্ট সদিচ্ছা। তাই আখ-চিনি-গুড় এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐকান্তিক ভালবাসা। সেকারণেই তাঁরই আদর্শের উত্তরসূরী হিসেবে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ আইন এবং ২০২০ সালে ‘বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট’ আইন মহান সংসদে অনুমোদিত হয়।
জাতির পিতা নিজে গুড় খেতে পছন্দ করতেন। তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিচারণমূলক এক লেখায় পাওয়া যায় তার চিত্র। ‘খাবার বেলায় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাবার শেষে দুধ ভাত-গুড় ও কলা খুবই পছন্দ করতেন।’ (আমার পিতা শেখ মুজিব। -শেখ হাসিনা। ১৩ আগস্ট ১৯৯১। সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র, আগস্ট ২০০৮)।
পল্লীর সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল মনের মিল। সাধারণ মানুষও তখন চিনির চেয়ে গুড়ই বেশি পছন্দ করতেন। গুড় গ্রামীণ শিল্প আজো আছে। তবে বর্তমানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গুড়ে ভেজাল মেশানোর অপচেষ্টায় আছে। এ অপচেষ্টা রোধ করলে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত হবে।
১মহাপরিচালক, ২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা। ফোন : ০৭৩২৫৬৫৩৬২৮, ই-মেইল : dg-bsri.gov.bd